ক্রমাগত বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি : সমাধান কোথায়?

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: গ্যাস-বিদ্যুৎ-তেল-সার দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। আরেকটি ‘মৌলিক’ অধিকার হলো এনার্জি বা জ্বালানি। জ্বালানির অধিকার কিংবা ডেটার অধিকার খুব শিগগিরই মৌলিক অধিকারের সমতুল্য হতে যাচ্ছে, কিংবা ইতিমধ্যে হয়ে পড়েছে।

সার কীভাবে জ্বালানির সাথে জড়িয়ে পড়ে? কেননা সার উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাস প্রয়োজন হয়। যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারে জীবাশ্ম জ্বালানির মূল্য ওঠানামা করছিল, এই বাজার যে এখন খুব স্থিতিশীল তাও বলা যায় না, তাই এসবের মূল্যও ওঠানামা করছিল।

আমাদের জালানি ব্যবস্থা গ্যাস ও তেলের উপর নির্ভরশীল। এর একটা বড় অংশ আমাদের বাইরে থেকে কিনতে হয়। অন্যদিকে আমাদের নিজেদের গ্যাস মজুদও স্বাভাবিক নিয়মেই কমে আসছে। ফলে উত্তোলিত গ্যাস ভাগ করে নিতে হচ্ছে—কিছুটা বিদ্যুতের উৎপাদনে, কিছুটা সার তৈরিতে।

এই ভাগাভাগিতে দামের সমন্বয় করতে হচ্ছে। উপরন্তু জ্বালানিতে সরকারি ভর্তুকিও একটা আছে। সেই ভর্তুকি কমানোর কিছু চাপ আছে। এই চাপ কিছুটা অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির কারণে, কিছুটা বৈদেশিক ঋণের শর্তের গৌণ মোকাবিলায়। এইসব মিলিত ফলের কারণে এই দাম বৃদ্ধি।

সরকার থেকে এই সতর্কবাণী ছিলই। আমরা এখন সেটা ধীরে ধীরে টের পাচ্ছি। এটা কতদিন চলবে, সেটা আমাদের পক্ষে বলা মুশকিল। যেহেতু ডলার-ঋণ-রিজার্ভ এই ত্রয়ীর প্রকৃত চিত্র সরকারের হাতে, তারাই ভালো জানে সংকট কতদিন, কীভাবে মোকাবিলা করতে পারবে। এই ব্যাপারে প্রকাশিত কোনো পথচিত্র বা শ্বেতপত্র আমাদের হাতে নেই।

সৌর শক্তি বা সোলার প্যানেল বাস্তবায়ন
সোলার প্যানেল বা সৌর বিদ্যুৎ একটা যুগোপযোগী নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস। এটি মূলত অর্ধপরিবাহী কেলাস থেকে নির্মিত পাতলা টিকলি। যা বিশেষ বৈদ্যুতিক সংযোগের অধীনে সূর্যরশ্মিকে বিদ্যুৎ প্রবাহে রূপান্তর করে। এর কিছু সমস্যা রয়েছে—এতে অনেক জায়গা লাগে, এর অ্যাফিশিয়েন্সি বা রূপান্তর দক্ষতা অনেক কম।

জায়গার ব্যাপারটা এ রকম- মোটাদাগে একশ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য সৌর প্যানেলের জায়গা লাগবে প্রায় সোয়া-তিনশ একর জমি। এটা কৃষিজমি যেখানে প্রাধান্য পায়, সেখানের জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জের। তাছাড়া বিগত বছরগুলোয় সোলার প্যানেলের মূল্যও বেশি ছিল, যেটা এখন অনেক কমে এসেছে।


জ্বালানির মূল্য সহনীয় রাখা রাজনৈতিক সুবিধার জন্যও প্রয়োজনীয়। মানুষের অর্থনৈতিক প্রাণ যাতে ওষ্ঠাগত না হয় সেদিকে নীতিনির্ধারকদের নজর দিতে হবে…


চিপের দক্ষতাও বেড়েছে, আগে ছিল প্রায় আঠারো শতাংশের এদিক-ওদিক, এখন একুশ শতাংশ বা তার বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো সুখবর। দুঃসংবাদ হলো, লাগাতার সৌর প্যানেল অন্য অনেক সমস্যার সৃষ্টি করবে, যেমন প্রচুর ব্যাটারি লাগবে, এর সাথে আবার দূষণও আছে, এই প্যানেলের রিসাইকেল কীভাবে হবে, রিনিউবেল এনার্জি গ্রিডে দেওয়া-নেওয়ায় চাই জরুরি সাবধানতা নতুবা গ্রিড বিপর্যয় হবে।

একটা পর্যায়ের বেশি নবায়িত শক্তি বৈদ্যুতিক গ্রিডে অনুপ্রবেশ করলে স্মার্ট গ্রিড থাকতে হবে, যেটা ইমপ্লিমেন্ট করা বাংলাদেশের জন্য অর্থের দিক দিয়ে বিরাট চ্যালেঞ্জ, মেগাওয়াট-ক্ষমতার ব্যাটারি স্টোরেজও অত্যধিক খরচ বহুল হবে।

সংকট হলো, মেঘ যখন আসবে তখন ছায়ার কারণে সিস্টেম থেকে ১০০-২০০ মেগাওয়াট মুহূর্তে হাওয়া হয়ে যাবে, এই পরিমাণ বিদ্যুতের তাৎক্ষণিক সরবরাহ নিশ্চিত করা সমস্যা। এটা আরও বড় সমস্যা হবে যখন হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেমে যুক্ত হবে। এর জন্য স্মার্ট গ্রিড ও নির্ভরযোগ্য ব্যাটারি স্টোরেজ লাগবে।

এসবের খরচ ও প্রযুক্তি-দক্ষতার সরবরাহ কুলিয়ে ওঠা বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল এবং এখনো আছে। এসব ছাড়াও সৌরবিদ্যুতের বাস্তবায়নের আরেকটি বাধা হতে পারে জীবাশ্ম-জ্বালানি চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগকারীদের পরোক্ষ চাপ, তারা চাইবে তাদের লগ্নি লাভসহ উঠে আসুক। এসব মিলিয়ে দূরের বাদ্য না-শুনে সম্ভবত সরকার নগদেই বেশি আস্থা রেখেছিলেন।

আইএমএফের ঋণ কি দায়ী?
আইএমএফের ঋণ কতখানি দায়ী সেটা অর্থনীতিবিদরা বলতে পারবেন। সাদা চোখে কিছু তো বর্তায়ই। বিদেশি ঋণ যখনই নেবেন, তারা কিছু শর্ত তো দেবেনই। সেই শর্ত পূরণ করতে হয়তো এই সব ড্রাস্টিক মেজারমেন্ট নিতে হচ্ছে। কিন্তু এটা আমাদের পক্ষে নিশ্চিত বলা সম্ভব নয়।

আমরা যেটা বলতে পারি, জ্বালানির মূল্য সহনীয় রাখা রাজনৈতিক সুবিধার জন্যও প্রয়োজনীয়। মানুষের অর্থনৈতিক প্রাণ যাতে ওষ্ঠাগত না হয় সেদিকে নীতিনির্ধারকদের নজর দিতে হবে। উদোর পিণ্ডি যেন বুধোর ঘাড়ে না যায়। কিন্তু অন্য দেশেও জ্বালানির মূল্য নিয়ে তুলকালাম চলছে, আন্তর্জাতিক এই ওঠানামা এবং বৈশ্বিক মন্দার দিক মাথায় রাখলে বাংলাদেশেও যে এমনটি হবে সেটা অনিবার্য ছিল। আশা করছি, অর্থনীতির পরিচালকগণ এমনভাবে সামনের দিনগুলোয় পরিকল্পনা সাজাবেন যাতে এই মূল্যবৃদ্ধি সহনীয় হয়।

ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি শিল্প যখন হুমকির মুখে
ক্ষুদ্র শিল্প বড় হুমকির মধ্যেই পড়বে। এবং গ্রীষ্মের আগামী দিনগুলোয় কীভাবে বিদ্যুতের লোডশেডিং হবে, গ্যাসের রেশনিং হবে সেইসব পলিসির ওপর আমাদের প্রবৃদ্ধিও নির্ভর করবে। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, সরকার সেসব নিয়ে ভাবছে এবং এখনই স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করছে।

আমাদের দরকার, এমন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা যা বাজারের প্রতিঘাত সহনীয় রাখে—অর্থাৎ আমদানি-রফতানির বিক্ষোভ এবং ডলার বিনিময় হারের ওঠানামা যথেষ্ট কুশনিং করে। এর সমাধান প্রযুক্তির হাতে নেই এই মুহূর্তে, যতটা এটা পরিকল্পনাবিদ এবং অর্থনীতিবিদদের হাতে। ফলে স্বল্প সময়ে প্রযুক্তির দিক দিয়ে আমি কোনো সমাধান দেখছি না।

তবে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে হয়তো কিছুটা সহনীয় হবে, তারপরও বলা যায় আমাদের গ্রিড নিউক্লিয়ার পাওয়ার নিতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। এই সেদিনও গ্রিড-বিপর্যয় ঘটেছে এবং তার অর্থ আমাদের গ্রিড-রেজিলিয়েন্সি সন্তোষজনক নয়।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়লেও তার সুফল কি মিলছে?
আমি বলব না যে সুফল মেলেনি। দীর্ঘদিন জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে থেকে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসে অবগাহন করে আমরা বিস্মৃত হয়েছি ২০০৯-পূর্ব বিদ্যুৎহীনতার অভিশাপ।

মারাত্মক সরবরাহজনিত সমস্যা থেকে উত্তরণের তখনকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে-কাজটি আওয়ামী সরকার করেছে তা নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী। তারা যেনতেন প্রকারে সরবরাহ বাড়িয়েছে, নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে ব্যবসায়ীদের নিয়ে এসেছে, তাদের আকর্ষণীয় প্যাকেজ দিয়েছে।

কেননা ব্যবসায়ীদের ডাকলেই তো তারা আসবে না যদি-না তাদের জন্য আকর্ষণ তৈরি করা যায়। এসবই করা হয়েছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্র রাতারাতি তৈরি করা যায় না- তাও মাথায় রাখা দরকার। এরই ফলশ্রুতি জিডিপি বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি।


শতভাগ বিদ্যুতায়ন অর্থ হলো শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় পড়েছে এটুকুই। এখন এর অর্থ এই নয় যে টেকনিক্যালি বিদ্যুতের সরবরাহ থাকবে…


এটা ভুলে গেলে চলবে না আকর্ষণের একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়াও আছে। সেই প্রতিক্রিয়ায় কিছু অতিরিক্ত সরবরাহ কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। ফলে এখন আমরা দেখছি সরবরাহ বেশি।

আরেকটা বিষয়, পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যানও জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে সরবরাহের একটি অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি করেছিল, যেটি ছিল, এখন আমরা জানি, ভ্রান্তি বিলাস।

শিল্প-কারখানা যেমন আশা করা গিয়েছিল তেমন বসেনি। ফলে আজও বৈদ্যুতিক লোডের পিক টাইম বা সর্বোচ্চ চাহিদার বিন্দু সন্ধ্যা-রাতে, অর্থাৎ আমাদের লোড রেসিডেন্সিয়াল লোড, ইন্ডাস্ট্রিয়াল লোড নয়। এর অর্থ আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নের এখনো বহু বাকি আছে। কাজেই সুফল মেলেনি- এ কথার সাথে একমত না হলেও করোনা পরবর্তী বিশ্বাবস্থা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের প্রবৃদ্ধিকে সাহায্য করছে না, বলা যায়।

শতভাগ বিদ্যুতায়নের পর বিদ্যুৎ বিপর্যয়
শতভাগ বিদ্যুতায়ন অর্থ হলো শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় পড়েছে এটুকুই। এখন এর অর্থ এই নয় যে টেকনিক্যালি বিদ্যুতের সরবরাহ থাকবে। কিন্তু এর ফলে একটা ভাইব আসে যে, আমরাও তাহলে বিদ্যুৎ পাব এবং তা সারাক্ষণ।

বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন এবং বৈশ্বিক চাপে পড়ে সেটা প্রায় উল্টো হয়ে গেছে। যখন এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, প্রাকযোগ্যতা যাচাই করা হয়, তখনকার দৃশ্যপট সম্পূর্ণ অন্যরকম ছিল। তখন আশার একটা আলোকবর্তিকা চারিদিকে ছেয়ে ছিল। এরপর এলো করোনা মহামারি। এর রেশ না মিলতেই এলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আপনি এতগুলো ধাক্কা কীভাবে সামলাবেন?

বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যে এই বহুধামুখী ধাক্কায় পড়েনি। কেবলমাত্র সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় কয়েকটি দেশ ছাড়া যাদের জনসংখ্যা অত্যল্প, উত্তুঙ্গ জিডিপি এবং অলৌকিক-নিয়তি বলে জীবাশ্ম-জ্বালানির যক্ষ-ভাণ্ডারের উপস্থিতি আছে। দূরদর্শিতা দিয়ে কি এতকিছু ছাপিয়ে ওঠা যায়?

ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, পরিচালক, জ্বালানি ও টেকসই গবেষণা ইন্সটিটিউট; অধ্যাপক, তড়িৎকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।

সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।